🧠 উইলিয়াম জোন্সের জীবনী: “ভারতীয় ভাষার প্রথম পাশ্চাত্য প্রেমিক” 📖

👶 শৈশব ও জন্মপরিচয়

উইলিয়াম জোন্স জন্মগ্রহণ করেন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৪৬ সালে, ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে। তাঁর পিতা উইলিয়াম জোন্স সিনিয়র ছিলেন একজন গণিতবিদ, আর মা মারিয়া জোন্স ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক। পিতার কাছ থেকেই ছোটবেলায় তাঁর মধ্যে ভাষা ও জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়।

পিতা যখন উইলিয়ামের মাত্র ৩ বছর বয়স, তখনই মারা যান। এরপর মা-ই তাঁকে পড়াশোনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন।

📚 শিক্ষাজীবন

উইলিয়াম জোন্স পড়াশোনা করেন হারো স্কুল এবং পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি–তে। অক্সফোর্ডে তিনি একাধিক ভাষা শেখেন, যেমন:

• ল্যাটিন
• গ্রিক
• হিব্রু
• আরবি
• পারস্য
• ফরাসি
• ইতালিয়ান
• স্প্যানিশ
• এবং পরে বাংলা, সংস্কৃত, উর্দু ও হিন্দিও!

তাঁর ভাষা শেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি প্রায় ২৮টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন, যার জন্য তাঁকে "লিঙ্গুইস্টিক জিনিয়াস" বলা হয়। 🗣️🧠

⚖️ আইনজীবী হিসেবে জীবন

১৭৭৪ সালে তিনি ব্যারিস্টার হন এবং আইনচর্চা শুরু করেন। এরপর তিনি ১৭৮৩ সালে কলকাতায় (তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া) হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান।

এটাই ছিল তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তনের সূচনা — কারণ ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল এখান থেকেই।

🇮🇳 ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়েই তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি, দর্শন, ভাষা এবং বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করেন।

তিনি প্রথম পাশ্চাত্য ব্যক্তি যিনি বলেন:

“সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার মধ্যে গভীর মিল রয়েছে।”
এ কথা তিনি বলেন ১৭৮৬ সালে, তাঁর বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক বক্তৃতায়।

এই পর্যবেক্ষণই পরবর্তীতে “ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার” ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। 🌍

📖 উল্লেখযোগ্য অবদান

1️⃣ Asiatic Society প্রতিষ্ঠা (১৭৮৪)

তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন Asiatic Society — এটি ভারতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ভাষা ও সংস্কৃতির গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এটি আজও বিদ্যমান, এবং এখনও গবেষণার অন্যতম প্রতিষ্ঠান।

2️⃣ অনুবাদ কর্ম

উইলিয়াম জোন্স অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যেমন:

• “শকুন্তলা” – কালিদাসের বিখ্যাত নাটক
• “মনুস্মৃতি” – হিন্দু আইনের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ
• হিতোপদেশ
• বিভিন্ন বেদীয় ও ধর্মগ্রন্থের অংশবিশেষ

এই অনুবাদগুলোর মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনের মূল্য স্পষ্ট হয়।

3️⃣ বিচারব্যবস্থায় সংস্কৃতির গুরুত্ব

একজন বিচারক হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতীয়দের বিচার ভারতীয় আইন মেনেই হওয়া উচিত। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলিম আইন বোঝার জন্য ধর্মগ্রন্থ ও ফকিহদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।

💬 বিখ্যাত উক্তি

“The Sanskrit language is more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either.”
— উইলিয়াম জোন্স

🧠 ভাষাবিজ্ঞান ও গবেষণা

তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাষাতত্ত্বে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেন। তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্ব অনুযায়ী, সংস্কৃত, গ্রিক, ও ল্যাটিন একই উৎসভাষা থেকে উদ্ভূত।

এই বক্তব্য থেকেই আধুনিক Comparative Philology ও Historical Linguistics-এর জন্ম হয়। 📚🌐

👨‍👩‍👧 ব্যক্তিগত জীবন

উইলিয়াম জোন্স বিয়ে করেন আন্‌না মারিয়া শিপলি নামে একজন বিদুষী মহিলাকে। তিনি ছিলেন একজন শিল্পপ্রেমী এবং নিজের স্বামীর চিন্তাভাবনা ও গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল সংযত ও সহযোগিতাপূর্ণ।

⚰️ মৃত্যু

দুঃখজনকভাবে, উইলিয়াম জোন্স মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান।
🗓️ তারিখ: ২৭ এপ্রিল ১৭৯৪
📍 স্থান: কলকাতা

তাঁর কবর আজও কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটারিতে রয়েছে।

🏆 উইলিয়াম জোন্সের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

• 🇮🇳 ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাশ্চাত্যে তুলে ধরেন
• 📚 Comparative Linguistics-এর জনক
• ⚖️ বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় আইনের প্রয়োগে অগ্রগামী
• 🏛 Asiatic Society প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহু গবেষণার পথপ্রদর্শক

📘 FAQ – প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন

❓ উইলিয়াম জোন্স কে ছিলেন?

👉 তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ ভাষাবিদ, বিচারক, অনুবাদক ও ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।

❓ তিনি কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন?

👉 কলকাতায় Asiatic Society of Bengal প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮৪ সালে।

❓ কবে ও কোথায় তাঁর মৃত্যু হয়?

👉 ১৭৯৪ সালে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

❓ তিনি কতটি ভাষা জানতেন?

👉 তিনি প্রায় ২৮টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

❓ কোন বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক তিনি অনুবাদ করেন?

👉 কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

🔚 উপসংহার

স্যার উইলিয়াম জোন্স ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ভারতের সংস্কৃতি ও ভাষাকে পাশ্চাত্যের দরবারে মর্যাদার সঙ্গে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানের সাধক, ভাষার প্রেমিক ও মানবিক বিচারবোধসম্পন্ন বিচারক।

তাঁর কর্ম আমাদের আজও স্মরণ করিয়ে দেয় — ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বন্ধন তৈরি করাই জ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য।

“একজন প্রকৃত পণ্ডিত তার নিজের সংস্কৃতির গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্য সংস্কৃতি বুঝতে চায়।”
– উইলিয়াম জোন্স